বিশ্বব্যাপী হার্ট ফেইলিওর মানুষের মৃত্যুর প্রধানতম কারণ। হৃদপিন্ডের অসুখটি যে ধরনেরই হোক না কেন (যথা: করোনারী ধমনীর অসুখ বা হার্ট অ্যাটাক, হার্টের ভাল্ভের অসুখ অথবা হৃদপিন্ডের মাংসপেশীর অসুখ বা কার্ডিওমায়োপ্যাথী), শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ হৃদরোগীই হার্ট ফেইলিওর এ আক্রান্ত হন। আমেরিকা মহাদেশে প্রতিবছর পাঁচ লক্ষ লোক হার্ট ফেইলিওরএ আক্রান্ত হয় এবং প্রায় আড়াই লক্ষ লোক এই রোগে প্রতি বছর মৃত্যুবরণ করে। ইউরোপে প্রতিবছর পাঁচ লক্ষ আশি হাজার লোক আক্রান্ত হন আর তিন লক্ষ মৃত্যুবরণ করেন। আমেরিকায় ৬৫ বা তদুর্ধ্ব বয়সীদের প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ১০ জনেরই হার্ট ফেইলিউর রয়েছে এবং সেদেশে শুধু হার্ট ফেইলিওর এর চিকিৎসা- বাবদ প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় চল্লিশ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হন দুই মিলিয়ন রোগী এবং এই মুহূর্তে প্রায় বাইশ মিলিয়ন রোগী হার্ট ফেইলিওর এ আক্রান্ত, এই সংখ্যাটি ২০৩০ সাল নাগাদ দ্বিগুন হবে (তথ্য সূত্র: ওর্য়াল্ড হেলথ ষ্টাটিস্টিকস্, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৫, অ্যামেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন ২০০২)। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ফ্রামিংহাম ষ্টাডিতে দেখা যাচ্ছে যে, হার্ট- ফেইলিওরে আক্রান্ত হবার পরবর্তীতে ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকেন মাত্র ২৫% পুরুষ ও মাত্র ৩৮% নারী। অথচ একই সময়ে সবধরনের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী পরবর্তীতে ৫ বছর বেঁচে থাকেন ৫০%। এইসব তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে হার্ট ফেইলিওর এর জীবননাশী মারাত্বক চিত্রটি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এধরনের কোন স্বীকৃত উপাত্ত না থাকলেও, এক বিশাল সংখ্যক হৃদরোগী এদেশেও হার্ট ফেইলিওর এ আক্রান্ত হচ্ছেন।
সাধারনত করোনারী ধমনীর অসুখ, কার্ডিওমায়োপ্যাথী, উচ্চ রক্তচাপ, বিভিন্ন ধরনের সংক্রমন (যথা-ভাইরাস) টক্সিন বা বিষাক্ত দ্রব্যাদি (যথা - এলকোহল, ক্যানসারের ঔষধ), ভাল্ভের অসুখ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা এ্যারিদমিয়া, ডায়াবেটিস, স্থুলকায় দেহ ও বৃদ্ধ বয়সের কারনে হার্ট ফেইলিওর হয়।
আক্রান্ত রোগীরা ধীরে ধীরে জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলেন। অস্বাভাবিক ক্লান্তি, কর্মক্ষমতা হ্রাস, শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা, ক্রনিক কাশি, শরীরে পানি জমা, রাতের বেলা বারংবার প্রসাব করা, ক্ষুধামন্দা ও অরুচি, ঝিমুনী ও ধীরে ধীরে মানসিক ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি রোগীকে গ্রাস করে।
এই রোগের চিকিৎসায় যে সব ঔষধ ব্যবহার হয়, (যথা-ডাই-ইউরেটিক বা মূত্রবর্ধক, ডিগক্সিন, বিটা ব্লকার, এ.সি.ই. ইনহিবিটর ইত্যাদি) তা রোগের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত রোগীকে আপাত সুস্থ রাখলেও, ঔষধ সেবনকারী রোগীদের প্রায় ৭৮% বছরে অন্তত দুবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ঔষধ সেবনকারী রোগীদের যাদের কষ্ট যথেষ্ট লাঘব হয় না, তাদের জন্য আশার আলো হয়ে এসেছে একটি বিশেষ ধরনের পেস্মেকার যন্ত্র- যার নাম বাই-ভেন্ট্রিকুলার বা দ্বি-নিলয় পেস্মেকার। এই পেস্মেকার যন্ত্রের সাহায্যে হৃদপিন্ডের নীচের দুই প্রকোষ্ঠ বা নিলয়কে একই সময়ে কৃত্রিম ভাবে পাম্প করানো হয় বলে ধীরে ধীরে রোগীর হৃদপিন্ডের পাম্প করার ক্ষমতা বাড়ে ও হৃদপিন্ডের যে অনিয়মিত পাম্পিং (যা ডিস্-সিনক্রোনি নামে পরিচিত) হয়, তারও উন্নতি ঘটে। এজন্য এর অন্য নাম সি.আর.টি (কার্ডিয়াক রি-সিন্ক্রোনাইজেশান থেরাপি)। শতকরা প্রায় ৮০% রোগীর ক্ষেত্রেই হার্ট ফেইলিওর এর সিম্পটম বা কষ্টসমূহ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। উন্নতবিশ্বে দ্বি-নিলয় পেস্মেকার প্রতিস্থাপন হার্ট ফেইলিওর রোগীদের জীবনযাপনের মান অনেকাংশে উন্নত করেছে। বাংলাদেশেও গত পাঁচ-ছ’ বছর যাবৎ বিভিন্ন বিশেষায়িত হৃদরোগ হাসপাতালে দ্বি-নিলয় পেসমেকার প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে সফলভাবে। এই পেসমেকার প্রতিস্থাপনে রোগীর খরচ হয় প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। প্রতিস্থাপনের পর শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ কমে আসার পাশাপাশি ঔষধও খেতে হয় কম।
এন্ড-ষ্টেজ-হার্ট ফেইলিওর এর রোগীদের জন্য এতদিন পর্যন্ত ঔষধ খাবার পাশাপাশি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু করার ছিল না। দ্বি-নিলয় পেসমেকার সেইসব রোগীদের জন্য অন্ধকারে আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে।